৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অব্যস্থাপনা

আপডেট: মার্চ ২, ২০২৪

| nirvik sangbad


হাসিবুর রহমান: ১০০ শয্যাবিশিষ্ট কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবকাঠামোর উন্নয়ন দেখলে মনে হবে বেশ ভালোই চলছে চিকিৎসা সেবা। বিষয় অনেকটা মাকাল ফলের মতো। সরকার সবকিছুর যোগান দিলেও ডাক্তারদের দায়িত্বের উদাসীনতা, সময়মতো না আসা, অনিয়মিতভাবে ডিউটি করা এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য। হয় না প্যাথলজির পরীক্ষা, কোটি টাকার ডিজিটাল এক্সরে মেশিন বাক্সবন্দি, একই অবস্থা কোটি টাকার অত্যাধুনিক জেনারেটর মেশিনটিও বাক্সবন্দি অবস্থায় রয়েছে। রোগীদের টয়লেটের অবস্থা নাজুক। হাসপাতালটিতে অনিয়মই যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। রোগীদের দুর্দশা ও ভোগান্তির শেষ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনী এলাকার হাসপাতালটির এমন বেহাল দশায় ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যার হাসপাতাল চালু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী এালাকার হাসপাতাল হওয়ায় হাসপাতালটিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় চিকিৎসার সকল আধুনিক সরঞ্জামাদী। অন্যান্য ১০০ শয্যা হাসপাতাল থেকে জনবলও এখানে অনেক বেশি। ধাপে ধাপে চিকিৎসক বাড়িয়ে এখন কর্মরত রয়েছে ২৪ জন চিকিৎসক। আছে কার্ডিওলজি, চর্ম ও যৌণ, মেডিসিন, গাইনী, শিশু, এ্যানেস্থেশিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আছে ডেন্টাল চিকিৎসক। গত এক সপ্তাহ ধরে সরেজমিন কোটালীপাড়া হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে সব মিলিয়ে ২৪ জন চিকিৎসক ৮ থেকে ১০ জন রোগী দেখায় নিয়োজিত। বাকিদের কোন হদিস নেই।
চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীরা অসহায়

গত ২৫ ফেব্র“য়ারী রবিবার সকালে সরেজমিনে কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর লেবার ওয়ার্ডে কথা হয় আখি ঢালীর সাথে। তার বাড়ি উত্তর কোটালীপাড়ার জহরেরকান্দি গ্রামে। ২৩ ফেব্র“য়ারী শুক্রবার সকালে গর্ভকালীন জটিলতা ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা নিয়ে কোটালীপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। আখির স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে ভর্তির তিন দিন অতিবাহিত হলেও কোন ডাক্তারের সাক্ষাত পাননি বলে অভিযোগ তাদের। শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়ায় বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেসে অবস্থান করছেন এবং হাসপাতালের বাইরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ঝুমা পালের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একই অভিযোগ করেছেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের লেবার ওয়ার্ডে ভর্তি কোটালীপাড়ার শুয়াগ্রামের চম্পা মজুমদারের স্বামী বিভূতি বল­ভ। তিনি বলেন, ডাক্তাররা ওয়ার্ডে আসেন না। কোন সমস্যা দেখা দিলে রোগীদের নিচতলায় জরুরী বিভাগে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়। হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি চলে যান উপজেলার বান্ধাবাড়ী গ্রামের খাদিজা বেগম। খাদিজা বেগমের স্বামী গাউস গোলদার জানান, দুইদিন হলো ভর্তি হয়েছি। তেমন কোন সেবা পাচ্ছি না। ওষুধ ও টেষ্ট সব বাইরে থেকে করতে হচ্ছে। তেমন কোন উন্নতিও হচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি থেকে কি লাভ। তাই নিজেরাই নাম কেটে চলে যাচ্ছি। রবিবার দুপুর সোয়া ১ টার দিকে সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে গাইনি ওয়ার্ডে ছুটে আসেন দায়িত্বপ্রাপ্ত গাইনী বিশেষজ্ঞ জুনিয়র কনসালন্টেট ডা. রাজিব রায়। কিন্তু কোন দায়িত্ব পালন না করেই সাংবাদিকদের এড়াতে তিনি সেখান থেকে দ্রুত সটকে পড়েন। হাসপাতালটিতে কর্মরত রয়েছে ৩২ জন নার্স। বেশিরভাগ নার্সই ঠিকমত ডিউটি করেন না বলে অভিযোগ রোগীদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা বলেন, নার্সদের ডাকলেও সময়মত তাদের পাওয়া যায় না। বারবার ডাকলে তারা বিরক্তি প্রকাশ করেন।
চিকিৎসা সেবায় মানা হচ্ছে না কোন সময়সূচী
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় সকাল আট টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত আউটডোরে রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও সাড়ে ন’টার আগে খোলা হয় না টিকেট কাউন্টার। ডাক্তাররাও আসেন আরো পরে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ২৪ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন (জুনিয়র কনসালটেন্ট) কার্ডিওলজি, চর্ম ও যৌণ, গাইনি অ্যান অবস, শিশু ও অ্যানেস্থেশিয়ার। এছাড়া রয়েছেন একজন ডেন্টাল সার্জন। এরমধ্যে একজন চিকিৎসককে (জুনিয়ার কনসালটেন্ট মেডিসিন) ডেঙ্গু কালীন সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন হাসপাতালে প্রেষণে পাঠানো হয়। ২৫ ফেব্র“য়ারী রবিবার সরেজিেমন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখো যায় মাত্র ৫-৬ জন চিকিৎসককে রোগী দেখার কাজে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। রোগীর চাপ থাকায় ওইসব চিকিৎসকদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে চিকিৎসা দিতে বেগ পেতে হচ্ছিল। কোটালীপাড়ায় ১১টি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে দূরবর্তী ৮টি কেন্দ্রে চিকিৎসক পদায়ন আছে। কিন্তু ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পদায়নকৃত চিকিৎসকরা কখনও যান না। ইউনিয়নের কেউ কখনো ওই সব উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ন্যুনতম কোন সেবা পাননা বলে তাদের অভিযোগ। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে চিকিৎসকরা কেবল মাত্র কাগজে কলমে কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। শুয়াগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যগেজ্ঞর বৈদ্য অনুপ অভিযোগ করে বলেন, পদায়নকৃত চিকিৎসকরা স্ব স্ব উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে চিকিৎসা দিলে দরিদ্র অসহায় মানুষদের দূর দুরান্ত থেকে অর্থ ব্যয় ও কষ্ট করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসার নামে হয়রানির শিকার হতে হতোনা। চিকিৎসকদের কর্তব্য পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে এবং তাদের ডিউটি রোস্টার ও ডিজিটাল হাজিরা তালিকা দেখতে চাইলে হাসপাতালটির প্রধান কর্মকর্তা ডা. নন্দা সেন গুপ্ত জানান, এগুলো সাংবাদিকদের দেখানো যাবে না।
আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে বাক্সবন্দি
একযুগ আগের এনালগ এক্সরে মেশিনে সনাতনি পদ্ধতিতে নাম মাত্র চলছে এক্সরের যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা। প্রায়ই সময় নষ্ট থাকে মেশিনটি। কোন রিপোর্ট দেওয়া হয় না। রোগীদের ধরিয়ে দেওযা হচ্ছে এক্স-রে ফিল্ম। যা রোগীদের কোন উপকারে আসেনা। লোক দেখানোর জন্য এটা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া কোটি টাকা মূল্যের পোর্টঅ্যাবল ডিজিট্যাল এক্স-রে মেশিন ৬-৭ বছর ধরে বাক্সবন্দী অবস্থায় রয়েছে। যা কোন কাজে লাগছে না। এক্সরে করার জন্য নিয়োজিত রয়েছে ২ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিও এন্ড ইমেজিং)। একই অবস্থা ডিজিটাল জেনারেটর মেশিনেরও। কোটি টাকা মূল্যের জেনারেটর মেশিনটি ব্যবহার না করে বাক্সবন্দি অবস্থায় রয়েছে বছরের পর বছর। বিদ্যুৎ চলে গেলে পুরো হাসপাতালে ভুতুরে অবস্থার সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটিতে ডেন্টাল ইউনিট তেমনভাবে কার্যকরি নেই। ডেন্টাল সার্জন ডাঃ নাজিয়া ইয়াসমিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের যন্ত্রপাতিহীন একটি ফাঁকা কক্ষে বসে চিকিৎসা দেন। অথচ পুরাতন ভবনে দাঁতের চিকিৎসার জন্য যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ একটি ডেন্টাল ইউনিট রয়েছে। যা বর্তমানে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বন্ধ রয়েছে প্যাথলজি পরীক্ষা
১০০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে প্যাথলজি পরীক্ষার যন্ত্রপাতিসহ সকল উপকরণ থাকলেও বন্ধ রয়েছে এই সেবা। শুধুমাত্র থেরোলজি কিছু পরীক্ষা হচ্ছে নামে মাত্র। যে কোন রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্য প্যাথলজির সিবিসি, আরবিএস, এইচবিএস এজি, ইউরিন আরই, ভিডিআরএল, ক্রস ম্যাচিং এরমতো নরমাল রোগ নির্ণয় পরীক্ষাও এখানে না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন রোগীরা। প্যাথলজির সমস্ত টেস্ট হাসপাতালের সামনের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করতে হচ্ছে। অথচ এখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) হিসেবে ৩ জন কর্মরত রয়েছেন। এ ব্যাপারে এখানে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) কনিকা রায় বলেন, আসবাবপত্রের অভাবে রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য প্যাথলজির সরঞ্জামাদি স্থাপন করতে না পারায় বন্ধ রয়েছে এই সেবা। রোগীদের অভিযোগ ডায়াগণস্টিক সেন্টারের সাথে যোগসাজগ করে এই সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে।
নামমাত্র চলে অপারেশন থিয়েটার
গাইনী ও এনেস্থেশিয়া কনসালটেন্ট থাকলেও তারা নিয়মিত অফিস করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তথ্যানুযায়ী জানা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সপ্তাহে দুই দিন ওটি করা হয়। জানুয়ারি মাসে ৯টি সিজারিয়ান অপরেশন ও ২৭টি নরমাল ডেলিভারি করা হয়। সাধারণ দরিদ্র রোগীরা হাসপাতালে ওটি’র সুযোগ পান না। সাধারনত বিশেষ শ্রেনীর মানুষ ও হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিদের পরিচিতজনরা এ সুবিধা পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোগীর স্বামী জানান, অনেক চেষ্টা করেও এখানে সিজার করাতে পারেন নি। বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে তার স্ত্রীকে সিজার করাতে হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন হাসপাতালের ১ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪ টি প্রাইভেট ক্লিনিক রয়েছে। এসব ক্লিনিকে গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ২০০ এর অধিক সিজার অপারেশন হয়। হাসপাতালের কর্মকর্তার যোগসাজগ ও দালাদের দৌরাত্মের ফলে রোগীরা হাসপাতালে সিজার অপারেশনের সুযোগ পায় না বলে অভিযোগ করেন রোগীরা।
রোগীদের টয়লেটের বেহাল দশা
হাসপাতালের নতুন ভবনের ৪ তলায় রয়েছে পুরুষ, মহিলা ও শিশু ওয়ার্ড। এই ৩ ওয়ার্ডের রোগীদের জন্য রয়েছে ৪ টি টয়েলেট। দেখাযায় ২ টি টয়েলেট রয়েছে স্থায়ী তালাবদ্ধ। ১ টি টয়লেট হাসপাতালের স্টাফরা ব্যবহার করেন। এটিও তালাবদ্ধ থাকে। অপর ১ টি মাত্র টয়লেটে পুরুষ-মহিলা সকল রোগীকে একসাথে ব্যবহার করতে দেখা যায়। রোগীদের ব্যবহারের টয়লেটটি ময়লা আবর্জনায় ভরপুর দেখা যায়। মনে হবে একটি ডাস্টবিনে ভাগার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা রোগী আক্ষেপ করে বলেন, অনেক মহিলারা পর্দা করে তারা পুরুষদের সাথে একই টয়লেটে কিভাবে যাবে? তাছাড়া টয়লেটটি ঠিকমত পরিস্কার না করায় দুর্গন্ধে ওখানে যাওয়া যায় না। তাই অনেক মহিলা রোগী বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বাহিরে বিভিন্ন বাড়িতে যায়। এ ব্যাপারে ডিউটিরত সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, দুই মাস যাবত টয়লেট দুটি বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি ইউএইচএফপিও ম্যাডাম বলতে পারবেন। রোগীদের টয়লেট তালাবদ্ধের বিষয়ে হাসপাতাল প্রধান ইউএইচএফপিও ডা. নন্দা সেন গুপ্তা বলেন, রোগীরা ঠিকমত টয়লেট ব্যবহার করতে জানে না। টয়লেট ২ টি ময়লায় জাম হয়ে গেছে। এখনো পরিস্কার করতে না পারার কারনে ২ মাস যাবত বন্ধ রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল মাধ্যমে রয়েছে অনিয়ম
হাসপাতালের সকল বিল অটোমেশন পদ্ধতিতে হওয়ার কথা থাকলেও এখানে মানা হচ্ছে না সেই নিয়ম। শুধুমাত্র রোগীদের টিকেট অটোমেশন পদ্ধতিতে হলেও রোগীদের কেবিন ভাড়া, এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাফী, ইসিজি, থেরোলজি পরীক্ষার বিল নেওয়া হয় হাতে লেখা রশিদের মাধ্যমে। ডিজিটাল হাজিরা মেশিনে ১৫ মিনিট সময় কমিয়ে রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, সারাবাংলাদেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উন্নয়ন ও সেবার উপর স্কোরিং করা হয়। কোটালীপাড়া হাসপাতালের অবস্থান গত ১ বছরেও ৩০০ এর উপরে থাকলেও বর্তমানে ৬১ নম্বরে উন্নীত হয়েছে। এ যেন জাদুর কাঠির ছোয়া। এত অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার পরও স্কোরিং এ এত উন্নতি নিয়ে সবাই হতবাক। অনেকেই মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ভুলভাল তথ্য সরবরাহ করে দূর্ণীতির মাধ্যমে এটা করা হচ্ছে। যা প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরীর কাজ কে কলংকিত করা হচ্ছে।
নানা দুর্ণীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ হাসপাতাল প্রধানের বিরুদ্ধে
গত ২৮ ফেব্র“য়ারী ২০২২ তারিখে কোটালীপাড়া হাসপাতালের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন ডাঃ নন্দা সেন গুপ্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে এক স্বাস্থ্য সহকারি জানান, ডাঃ নন্দা সেন গুপ্তা একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য হাসপাতালে যোগদানের পর পরই নানা দুর্ণীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এমএইচভির ভলান্টিয়ারদের কাছ থেকে বেতনের একটি অংশ কেটে রাখেন তিনি। এছাড়াও বিভিন্ন বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার না করে সরকারি অর্থ লোপাট করেন। এসব অর্থ হাসপাতালের কয়েকজনকে নিয়ে ভাগবাটোরোয়াও হয় বলে নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন এক স্বাস্থ্য সহকারি। জানা যায়, এসব দুর্নীতির টাকা জমা রাখা ও সময়মতো ভাগবাটোয়ারের জন্য ডা. নন্দা সেন গুপ্তা ও হাসপাতালের হেড ক্লার্ক ঝন্টু বাবু গত বছরের ১৮ মে কোটালীপাড়ার ঘাঘর বাজার সোনালী ব্যাংকে একটি যৌথ সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। যার নম্বর ৬১০৪৪০১০২৫৫৭৯। এখানে কয়েক দফায় কয়েক লক্ষ টাকার লেনদেনও হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হলে সব টাকা উত্তোলন করে হিসাবটি বন্ধ করে দেয়। তার স্বেচ্ছাচারিতায় অতিষ্ঠ হয়ে গত বছরের ৬ জুলাই ৩৬ জন স্বাস্থ্য সহকারি ডা. নন্দা সেন গুপ্তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন। পরবর্তীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করার নেতৃত্ব দেওয়া স্বাস্থ্য সহকারি হাফিজুর রহমানকে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলী করেন। এরপরই কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরী করে কথায় কথায় কারনে-অকারনে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শোকজ করে ভীতি সন্ত্রস্ত করে রাখেন বিরুদ্ধে যাতে কেউ কোন কথা না বলতে। হাসপাতালের দারোয়ান থেকে আরএমও পর্যন্ত প্রায় শতাধিক ব্যক্তি পেয়েছেন এই শোকজের নোটিশ। যে কারনে তার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্ণীতির বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। অনেক কর্মচারীর বেতন পর্যন্ত বন্ধ রেখেছেন। তার এসব অপকর্মে সহযোগিতা করেন গোপালগঞ্জের সাবেক সিভিল সার্জন নিয়াজ মোর্শেদ (যিনি দুর্ণীতির জন্য দুদকের মামলায় অভিযুক্ত)।
জানা যায়, গত বছরের ৩০ জানুয়ারী রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপসচিব সারমিন সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ডাঃ নন্দা সেন গুপ্ত কে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদায়ন করে বদলী করা হয় পাবলিক হেলথ এন্ড হসপিটাল এডমিনিস্ট্রেশন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), ঢাকায়। কোটালীপাড়া হাসপতালের দূর্ণীতির টাকার মায়ায় পদোন্নতি না নিয়ে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন এখানে থেকে যাওয়ার জন্য। ম্যানেজও করে নেন। প্রধানমন্ত্রী যেখানে সারা বাংলাদেশকে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেখানে প্রধানমন্ত্রীর নিজ এলাকা কোটালীপাডার ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটি এনালগ করে রেখে দূর্ণীতির স্বর্গরাজ্যে বানিয়েছেন এই দুর্নীতিবাজ ডাক্তার নন্দা সেনগুপ্ত একথা এখন সকলের মুখে মুখে।
কোটালীপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ দাড়িয়া অভিযোগ করে বলেন, ২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করেন। এরপর ধাপে ধাপে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ ও আধুনিক ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়। ১০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগের থেকে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু সবকিছু থাকার পরও চিকিৎসকদের উদাসীনতার কারনে রোগীরা সেবা না পেয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে ও জেলা শহরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যারা আছেন তারা বাসা ও প্রাইভেট ক্লিনিকে প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অনেক রোগী জানেন না, কোটালীপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। হৃদরোগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছে- আমি নিজেও জানিনা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সব ব্যবস্থা করলেও, এ যেন কাজির গরু কিতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই এমন অবস্থা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তার অদক্ষতাকে এজন্য দায়ি করেন তিনি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনী এলাকায় ২ টি ১০০ শয্যার হাসপাতাল। একটি টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় অন্যটি কোটালীপাড়া উপজেলায়। টুঙ্গিপাড়া ১০০ শয্যা হাসপাতালে ওখানকার রোগীরা যে সেবা পাচ্ছে আমরা তার ছিটেফোটাও পাই না। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ভোটারদের চিকিৎসাসেবার জন্য কোটালীপাড়া হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার, নার্স ও স্টাফ দিয়েছেন। শুধুমাত্র একজন স্বেচ্ছাচারী ও অদক্ষ কর্মকর্তার কারনে সাধারণ রোগীরা বঞ্চিত রয়েছেন সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে।
কোটালীপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নন্দা সেন গুপ্তা বলেন, জনবল সংকটের কারনে কিছু সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার বিষয়ে ইতোমধ্যে তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনটি বাক্সবন্দী থাকার কারন হিসেবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলার দুদকে মামলা চলমান থাকার কথা উলে­খ করেন। রোগীদের অভিযোগ ও গণমাধ্যমের পর্যবেক্ষণ পাত্তা দিতে নারাজ তিনি।
গোপালগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. মোঃ জিল­ুর রহমান জানান, কোটালীপাড়া হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম ও হাসপাতাল
প্রধানের দুর্ণীতি নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি আমি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠিয়েছি।