৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

নিমতলী, চুড়িহাট্টার পর ট্রাজেডির খাতায় ‘বেইলি রোড’র নাম

আপডেট: মার্চ ১, ২০২৪

| palash

অসংখ্য বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী রাজধানী ঢাকা। এসব ঘটনায় বহু প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘটনা ঘটলে কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। তখন নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়। নানা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। কিন্তু পরে তার বেশিরভাগই আর আলোর মুখ দেখে না। এরপর ধারাবাহিকভাবে এমন সব দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। ২০০৯ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটিতে আগুন, ২০১০ সালে নিমতলী ট্রাজেডি এবং ২০১৯ সালের চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনা মনে হলে এখনো শরীর শিউরে ওঠে। এবার সেই ট্রাজেডির খাতায় উঠলো ‘বেইলি রোড’র নাম।
অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো ভবন বা বাসাবাড়িতে অগ্নি দুর্ঘটনা ঠেকাতে বা এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে ভবন নির্মাণ পর্যায় থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক এবং অগ্নি নিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান বিএম ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর এ কে এম শাকিল নওয়াজ বলেন, আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব, যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়। কোনো ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। একটি হলো সক্রিয় ব্যবস্থা এবং অন্যটি হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।

তিনি বলেন, অগ্নি নিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আগুন ধরে গেলে সেটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া।

সবশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া চিকিৎসাধীন আহতরা কেউ শঙ্কামুক্ত নন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে বলে জানিয়েছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. সামন্ত লাল সেন নিজেই জানিয়েছেন।

ভবনটি যেন অগ্নিচুল্লি ছিল:
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন বলেন, নিহতদের বেশিরভাগ অক্সিজেন স্বল্পতায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। প্রচুর পরিমাণে সিলিন্ডার থাকায় ভবনটি ছিল অগ্নিচুল্লির মতো। ফলে আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যারা মারা গেছেন তাদের আগুনে দগ্ধ না হয়ে অক্সিজেন স্বল্পতায় মারা গেছেন।

নিমতলীর আগুনে প্রাণ হারান ১২৪ জন:
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগে যায়। এতে নারী-শিশুসহ নিহত হয় ১২৪ জন। আহত হয় অর্ধশতাধিক। নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত ৯টায় ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সে সময় ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় দুই বোন রুনা আর রত্মা এবং পাশের বাড়িতে আসমা নামে এক মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। কনেরা পার্লারে সাজছিল। রান্নার জায়গার পাশেই ছিল কেমিক্যালের গুদাম। প্রচণ্ড তাপে গুদামে থাকা কেমিক্যালের প্লাস্টিক ড্রাম গলে যায়। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মুহূর্তেই নিমতলী যেন মৃত্যুকূপ হয়ে ওঠে! নিমতলী ট্র্যাজেডি আলোড়ন দেশজুড়ে ফেলে।

চুড়িহাট্টার আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু:
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। রাত পৌনে ১১টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে একাধিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে আগুন ছড়িয়ে পড়ে সড়কে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেটকার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি ও মোটরসাইকেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। ১৪ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর এখনো দিন কাটে সেই রাতের বিভীষিকা মাথায় নিয়ে।

এফআর টাওয়ার ট্র্যাজেডিতে প্রাণ যায় ২৬ জনের:
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ৭০ জন। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন যখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তখন ভবনের ভেতর আটকে পড়া অনেকে ভবনের কাঁচ ভেঙে রশি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। এ সময় কয়েকজন নিচে পড়ে মারা যান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ৬ ঘণ্টা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সেদিন হেলিকপ্টার দিয়ে গুলশান-বনানী লেক থেকে পানি সংগ্রহ করে ভবনে ছিটানো হয়। অগ্নিকাণ্ডের জন্য ভবনের অনুমোদন, নকশার ত্রুটি ও অগ্নিনিরাপত্তাকে দায়ী করা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সব উদ্যোগ থেমে যায়।

মগবাজারে বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু:
২০২১ সালের ৭ জুন মগবাজারে ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক। বিস্ফোরণের শব্দ এতটাই বিকট ছিল যে প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা বলেছিলেন- এমন আওয়াজ তারা আগে শোনেননি।

বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটে আগুন
২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরো চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়- মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এ ঘটনা ঘটে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ৩০৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

একইভাবে গত বছরের ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউমার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ২২৬টি দোকান পুড়ে যায়। মার্কেটের মালিক সমিতি তখন জানায়, আগুনে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শটসার্কিট) থেকে আগুন লাগে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি।

আগুন লাগার কারণ নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন:
২০২৩ সালে ফায়ার সার্ভিস তাদের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশে আগুন লাগার বড় কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিদুর্ঘটনার ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে আগুনের সূত্রপাত হয় বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। আরো কিছু কারণও খুঁজে পায় তারা।

তাদের হিসাব অনুযায়ী, আগুনের ঘটনার দ্বিতীয় বড় কারণ বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা। ২০২২ সালে ১৬ শতাংশের কিছু বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে এ কারণে। প্রায় ১৪ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে চুলা থেকে। সেটি বৈদ্যুতিক, গ্যাস বা মাটির চুলা হতে পারে। গ্যাস সরবরাহ লাইনও আগুনের ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ। ২০২২ সালে ৩ শতাংশের কিছু বেশি আগুনের ঘটনা ঘটে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে।

আগুন দুর্ঘটনা ঠেকাতে যেসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে তা হলো-

১. ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা:
আধুনিক বহুতল ভবনগুলিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, হিটিং, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগের জন্য যে পাইপগুলো টানা হয়, সেগুলো যায় ডাক্ট লাইন এবং ক্যাবল হোলের ভেতর দিয়ে। এই ডাক্ট লাইন ও গর্ত দিয়ে ধোঁয়া এবং আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোলগুলো আগুন প্রতিরোধক উপাদান দিয়ে ভাল করে বন্ধ করে দিতে হবে। এছাড়া ভবনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার জন্য ব্যবহৃত কোনো কিছুর মাধ্যমেও যাতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

২. আগুন প্রতিরোধী উপাদান ব্যবহার:
আগুন দুর্ঘটনা ঠেকাতে এ ধরনের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে দরজা এবং দেয়াল আগুন প্রতিরোধী হলে ভালো হয়। ঘরের সিলিং, রান্নাঘরের আসবাবপত্র আগুন প্রতিরোধী পদার্থে নির্মাণ এবং আগুন প্রতিরোধী তার ব্যবহার করলে আগুন লাগলেও সেটি ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে না। সিনথেটিক বা হাইড্রোকার্বন উপাদান থাকে এমন কোনো পদার্থ দিয়ে ভবনের ভেতরের সাজসজ্জা না করাই ভালো।

৩. অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো:
প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়ার পরও যদি কোনো ভবনে আগুন লাগে তাহলে সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতিয়ে কমিয়ে আনার একটা উপায় হচ্ছে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো এবং সেটি ঠিক মতো কাজ করে কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা করা।

৪. জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিত করা:
ভবনেই আগুন লাগলে সেটি থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাইরে একটা জরুরি বহির্গমন পথ থাকতে হবে। এটা হতে হবে এমন একটি পথ যেখানে আগুন এবং ধোঁয়া প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ কোনো ভবনে আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে ঐ ভবনের লিফট ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

৫. ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা ও ব্যবহার করা:
প্রতিটি ভবনেই অগ্নি নির্বাপণ সিলিন্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এগুলো ব্যবহার করতে জানতে হবে ভবনের বাসিন্দাদের।

৬. স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম:
আগুন নেভানোর জন্য একটা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা হচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। এটি কোনো একটি ভবনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ ব্যবস্থায় কোনো একটি স্থানে তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পানি ছিটিয়ে পড়তে থাকে।

৭. নিয়মিত মহড়া:
ফায়ার এক্সটিংগুইশার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, আগুন লাগলে কীভাবে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকতে হবে। ভবনে আগুন লাগলে সেখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসতে হবে তার জন্য নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভবনের সব বাসিন্দাদের অংশগ্রহণে মাসে অন্তত একবার এ ধরনের মহড়া করা উচিত।

আরো যেসব বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে :
* রান্নার পর চুলা সম্পূর্ণভাবে নিভিয়ে রাখুন।
* ভেজা কাপড় চুলার ওপর শুকাতে দেবেন না।
* গ্যাসের চুলা জ্বালানোর ১৫ মিনিট আগে রান্নাঘরের দরজা জানালা খুলে দিন।
* গ্যাসের চাবি অন করার আগে ম্যাচের কাঠি ধরাবেন।
* চুলা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরির্বতন করে ফেলুন।
* বৈদ্যুতিক লাইন ৬ মাস পরপর পরীক্ষা করুন।
* ভালোমানের বৈদ্যুতিক তার ও সরাঞ্জম ব্যবহার করুন।
* প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নি-নির্বাপক যন্ত্র মজুত রাখুন।

আগুন লাগার পর যা করতে হবে:
* বিলম্ব না করে নিকটস্থ ফায়ার স্টেশনে সংবাদ দিন অথবা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে (০২-৯৫৫৫৫৫৫/০১৭৩০৩৩৬৬৯৯) অবহিত করুন। আগুন নেভানোর জন্য তারা সব সময় প্রস্তুত থাকেন।
* শুরুতে সতর্ক থেকে আগুন নেভানোর চেষ্ট করুন।
* বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপনী ব্যবহার করুন।
* বৈদ্যুতিক লাইনে আগুন ধরলে পানি ব্যবহার করবেন না। এতে ফায়ার এক্সটিংগুইসার ব্যবহার করুন। এটি না পেলে শুকনো বালি ব্যবহার করুন।
* গায়ে বা পরনের কাপড়ে আগুন ধরলে মাটিতে গড়াগড়ি করুন।