৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

ড. মোল্ল্যা রেজাউল করীমের ভাবনায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৪

আপডেট: মার্চ ৯, ২০২৪

| nirvik sangbad


একজন মমতাময়ী নারী -একজন মা’য়ের প্রতি শ্রদ্ধা। জেলা শহর সাতক্ষীরা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের কোন এক অজপাড়াগাঁও এ আমার জম্ম। আধুনিকতার ছোয়া বিবর্জিত গ্রামীন জনপদে আমার শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোতে ঝলমলে আলোকের নিত্য পসরা ও নিয়ন বাতির ফকফকা কৃত্রিমতা না থাকলেও কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল স্নেহ, মমতা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার সৌরভ-সৌকর্যে। দিনগুলো তাই চিরস্মরণীয়, চিরভাস্মর, চিরগৌরবের হয়ে আছে, থাকবে আজীবন।
আব্বা-মা এবং বড় চাচা-চাচী’র যৌথ সংসার ছিল আমাদের। আব্বারা ছয় ভাই ও একবোনের সুখের সংসারে মোটামুটি স্বচ্ছলতা ও সামাজিক মর্যাদায় দাদা দাদি সহ ছিল তাদের বাস। প্রাক-আধুনিক সেই সময়ে সুখের স্থায়িত্ব খুব বেশিদিন হতে পারেনি। গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের মতোই আমাদের পরিবারে হানা দিলো কলেরা নামক সর্বগ্রাসী মহামারি। অকৃপণ থাবায় কেড়ে নিলো আমার দাদা, বড়চাচা, সেজচাচা সহ আব্বার ছয় ভাই এর মধ্যে চারজন সহ দাদার জীবন। মাত্র একমাসের মধ্যেই একই পরিবারের তরতাজা পাঁচটি জীবন হানীতে নিঃস্ব, রিক্ত, কূলকিনারা হীন অথৈ অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো মোটা চালের ভাত আর মোটা কাপড়ে দিনাতিপাত করা পরিবারটি।
মরিমরি করেও বেঁচে রইলেন মেঝ চাচা, দেড়বছর বয়সী আমার আব্বা, দাদি এবং কয়েকমাস বয়সী ফুফু।মেঝ চাচার তখন বয়স তের বছর। নিরুপায়, নিঃস্ব ও গত্যান্তরহিন পরিবারটির তিনিই হাল ধরলেন অগত্যা। কঠোর ও অমানুষিক পরিশ্রমে চারজনের সংসারের চাকা চলন্ত রাখতে তার অবদান ছিল অবর্ননীয়। অপরদিকে চারসন্তান ও স্বামীহারা সদ্য বৈধব্যের ধকলে দিশাহারা আমার দাদি পাগল হয়ে গেলেন। মাত্র তের বছর বয়সে এতসব পারিবারিক নিষ্পেষণে মাত্রা যোগ হলো গ্রামীন সমাজের কি নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারীদের অমানবিক নিষ্ঠুরতা। তারা দাদার রেখে যাওয়া সম্পদ ও সমাপ্তি নানান কুটচালে হস্তগত করে আরো সর্বস্বহারা সম্বলহীন করে দিয়েছিল শোকসন্তপ্ত, সান্ত্বনাহীন পরিবারটিকে।
এহেন মহা বিপর্যয় কাটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার অসামঞ্জস্য ও প্রায় অসম্ভব সংগ্রামের সিপাহসালার হিসেবে সকল দায়িত্ব নিজস্কন্ধে তুলে নেন আমার বেঁচে যাওয়া মেঝ চাচা। সময়ের পরিক্রমায় তিনিই হয়ে ওঠেন আমারন বড় চাচা। মাত্র ২২ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বড় চাচা ঘরে আনেন তার সহযোদ্ধা আমার বড় চাচি তথা বড়মা কে। আমার বড়মার নাম ছিল নজিরন নেছা।
বিধ্বস্থ ও বিপর্যস্থ একটা পরিবারে আমার বড়মা যখন আগমন করেন তখন আমার বাবার বয়স ছিল মাত্র সাড়েনয়-দশ বছর। সন্তান সম স্নেহের পরশে তাকেও মানুষ করার আপ্রান চেষ্টায় তিনি যোগ হন বড়চাচার সঙ্গে, সংসারের পুনঃর্গঠন ও স্বচ্ছলতা প্রতিষ্ঠায়।
আমার পিতা ২১ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তার সংসারে আমি সহ মোট পাঁচ ভাইবোন। আমাদের যৌথ পরিবারে বড়চাচার একটি মাত্র মেয়ে এবং তার বিয়ে হয়েছে আমি স্কুল যাত্রা শুরুর আগেই। ফলে আমাদের যৌথ পরিবারে সন্তান সন্ততি বলতে আমরা পাঁচ ভাইবোন। বড় চাচার মতই বড়মা আমাদের পরিবারে অভ্যান্তরিন প্রধানের ভূমিকা পালন করেন অনন্যসাধারণ আন্তরিকতা ও স্নেহ ভালোবাসার পরিপূর্ণ উদার হস্তে।
জম্মের পর হতে তাই আমরা পাঁচ ভাইবোন বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি, পারিবারিক সাপোর্টের সবটুকু পেয়েছি বড়চাচা ও বড়মার কাছে। আমাদের জন্য তাই বড়মাই ছিলেন আসল মা এবং আমার নিজের মা ছিলেন ছোটমা হিসেবে। বড়মার কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে, তার হাতে খেয়ে, তার আদর যত্নে বড় হয়েছি আমরা। বড়মার কাছে বিভিন্ন গল্প শোনা, গজল শোনা, বইয়ের গল্প পড়ে শোনানো, গান গেয়ে ঘুম পড়ানো, নবী রাসুল (স:) দের জীবনের কথা নামাজ রোজার নিয়ম, সুরা মুখস্থ করা সবই বড়মার কোলের মধ্যে শুয়ে শুয়ে। খাবার শেষে হাত ধুয়ে ভিজা হাতটি বড়মার শাড়ির আচলে মুছে দেওয়া ছিল আমার প্রত্যহিক অভ্যাস।
বড়মা মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে দুটি পুকুর ও বাড়ি সন্নিহিত বিলে মাছনধরা, বক ধরা, অতিথি পাখি ধরার কলাকৌশল শিখেছি বড়মার কাছে। তার সাথে আশৈশব কত কথা, কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনার দিনলিপি তা বর্ননা করে শেষ করা যাবেনা।
সেই মমতাময়ী, মহীয়সী নারী, আমার হৃদপিণ্ডের বড় অংশটি যার সাথে বাঁধা সেই স্নেহময়ী বড়মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে, আমাদের ছেড়ে মহান আল্লাহর দরবারে সাড়া দিতে চিরবিদায় নিয়েছেন ১৭ জুন-২০২৩ রাত ১১.৪৫ মিনিটে। আমি সেই রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রওনা হয়েও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারনে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত আটকে ছিলাম চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে। রাত ১.৪৫ মিনিটে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে মোবাইলে জানতে পারলাম তার শেষ বিদায় ও বিদায় কালীন আকুতির কথা। শেষ দেখাটি হয়নি বড়মার সঙ্গে। মৃত্যু যাত্রায় তিনি বারংবার উচ্চারণ করেছেন আমার নামটি। সবার কাছে অনুরোধ করে আমাকে একটিবার দেখতে চেয়েছিলেন বারবার। তার মৃত্যু শয্যা পাশে নিরন্তর হাতড়ে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন আমাকে। স্বগতোক্তি করেছেন অনেকবার আমাকে না পাওয়ার আক্ষেপে। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমাকে তিনি শেষ দেখাটি দেখতে পারেননি, আমিও বঞ্চিত হয়েছে তাকে শেষ যাত্রাকালে দেখা ও পাশে থাকার। মহান আল্লাহ যেন স্নেহবাৎসল্যে আকন্ঠ পরিপূর্ণ আমার বড়মার সাথে জান্নাতুল ফেরদৌসের সিড়িতে সাক্ষাতের সুমহান সৌভাগ্য ও সৌজন্য দান করেন।
বড়মার চিকিৎসা জনিত ব্যয়, নিত্য কিছু হাতখরচের টাকা দিতাম আমি। তিনি টাকা বেশি ব্যয় না করে রেখে দিতেন।পাড়ার মানুষকে ডেকে দেখাতেন টাকাগুলো, আর গর্বে খুশিতে বিগলিত হতে হতে বলতেন, “তোমরা দেখো আমার রেজাউল কত বড় বড় টাকা দিয়েছে আমাকে- এতবড় টাকা কি খরচ করা যায়?”। আমার কর্মস্থল সহ চলতি পথের নিরাপত্তা নিয়ে তার উদ্বেগের শেষ ছিলনা। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরে মোবাইলে কল দিয়ে বেশি কিছু বলতেন না, তবে বারবার আমার নামধরে ধরে ডাকতেন। আমি কোন প্রশ্ন করলে হাসিমুখে বলতেন, “আমাকে নিয়ে তুই চিন্তা করিস কেন?” দিনের একটা বড় অংশ তিনি জায়নামাজে অতিবাহিত করতেন, আর আমার নাম উচ্চারণ করে করে দোয়া করতেন। আমার দোয়ার সুমহান এই ভান্ডার আজ মাটিতে গহীনে।
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমার জন্য কলিজা উজাড় করে দেওয়া, আমার স্নেহময়ী, মমতাময়ী মহীয়সী বড়মার জন্য হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা, ভালবাসা ও দুচোখ প্লাবিত দোয়া মহান রবের দরবারে। হে বিশ্ব জাহানের মালিক, আরশের মালিক, বিচার দিবসের মালিক, দয়াময় গাফুরুর রহিম, আমার বড়মা, বড়চাচা সহ সকল করববাসীকে তোমার নিজস্ব অনুগ্রহে জান্নাতুল ফেরদৌসের সম্মানিত অতিথি হিসেবে কবুল করো মাবুদ। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানী ছাগিরা।